নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ,জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ সালে ওড়িশার কটকে,যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক চিরস্বরণীয় কিংবদন্তি নেতা। তিনি হলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অতি উজ্জ্বল এবং মহান চরিত্র, যিনি এই মহাসংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে ইংরেজদের কাছে থেকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য তিনি যে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন তার জন্যই হয়তো আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তার এই সংগ্রামের জীবনে অনেক রকমের ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে একটা ঘটনা ছিল তার ছদ্ববেশে জার্মানিতে পালানোর ঘটনা।আজকের বিষয়ে তার সেই পালানোর ঘটনায় আমরা তুলে ধরবো। নেতাজির জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা আমরা অনেক রকমের বই থেকে, ইন্টারনেট থেকে , অনেক আর্টিকেল থেকে , এমনকি তার জীবনকে তুলে ধরার ফিল্মের মাধ্যমে আমরা আজকে জানতে পারছি।
১৯৩৯ সালে ভারতে একটি বামপন্থী জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিল যেটা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে মতভেদের জেরে তৈরী করা হয়।এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি মনে করেন গান্ধীজির অহিংসা এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই তিনি বামপন্থী দলটি গঠন করেন যার নাম দেন ফরওয়ার্ড ব্লক।
১৯৪০ সালের ২ জুলাই কলকাতাতে নেতাজি নিজের দল নিয়ে একটা যাত্রা পরিচালনা করছিলেন ,ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ সরকার দ্বারা তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে রাখা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।ফরওয়ার্ড পত্রিকায় “The day of reckoning“ (বোঝাপড়ার দিন) এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য সুভাষকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে আলিপুর ফৌজিদারি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। জেলে বন্দি থাকা সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে অনশন শুরু করে দেন।(“Release me or I shall refuse to live“).তার কিছু দিন পরেই তার শরীর খারাপ হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার তার এই অবস্থা দেখে ১ সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেন যে তাকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তাকে তার বাড়িতেই নজরবন্দি করে রাখা হবে। কারণ ব্রিটিশ সরকার চাইছিলেন না তাদেকে কেউ দোষারোপ করুক জেলের মধ্যে সুভাষের মৃত্যর জন্য। তাই ৫ ডিসেম্বর তাকে জেল থেকে এলগিন রোডে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।সেই বাড়িতেই তিনি একটা ঘরে একাই থাকতে শুরু করেন এবং বাড়ির কারো সঙ্গে দেখা ও করেন না।আর ভিতরেই শুরু করেন কিভাবে এই ইংরেজী গোয়েন্দাদের চোখে ধূলি দিয়ে ভারতের সীমানা পেরিয়ে জার্মানিতে যাওয়া যায়।জার্মানিতে গিয়ে তাদের থেকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাহায্য চাওয়া যায়। কিন্তু জার্মানি যাওয়া যায় কিভাবে এই চিন্তা করতে করতে তিনি পাঞ্জাবে অবস্থিত একটা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জানতে চান যে কোনো রকমের পথ আছে যে বর্ডার পেরিয়ে জার্মানিতে সে যেতে পারে। সেই দলের একটা নেতা সুভাষকে জানায় যে একটা পথ আছে যার মাধ্যমে তিনি জার্মানিতে যেতে পারবেন যেটা হলো আফগানিস্থানে গিয়ে সেখান থেকে সোভিয়েত উনিয়ন পৌঁছে তারপর তিনি জার্মানি যেতে পারবেন। এর পরেই সুভাষ সিদ্ধান্ত নেন যে এই পথ দিয়েই তিনি জার্মানিতে যাবেন।তারপর আসে সেই রাত যখন তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রায় রাত দেড়টা নাগাদ ইংরেজ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি তার বাড়ি থেকে বাইরে আসার সুযোগ পান।সেই সময় তার সঙ্গে ছিলেন তারই ভাইপো শিশিরকুমার বোস সেই সময় সুভাষ ছদ্ববেশে ছিলেন মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন নামের এক ব্যাক্তি যিনি একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট।তখন তার পরণে ছিল বাদামি রঙের গলাবন্ধ লম্বা কোটের সঙ্গে ঢোলা পায়জামা আর মাথায় কালো ফেজ টুপি, পায়ে পুরানো ফিতে বাঁধা মজবুত জুতো আর সঙ্গে পুরানো কাঁচের চশমা।বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর সুভাষ গাড়িতে উঠলেন এবং শিশির অন্ধকারে সারা রাত গাড়ি চালিয়ে সকাল প্রায় সাড়ে আটটার দিকে ধানবাদে পৌঁছে যায়। সেই খানে তার আর এক ভাইপো অশোকনাথের বাড়ি। সেই বাড়িতেই তিনি উঠবেন আর নিজেকে ইন্সুরেন্স এজেন্ট হিসাবে পরিচয় দিবেন।ঠিক তাই হলো অশোকনাথের বাড়ি থেকে প্রায় চারশো গজ দূরে শিশির সুভাষকে নামিলে দিলেন আর নিজে গাড়ি নিয়ে অশোকনাথের বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। সুভাষকে দূরে নামানোর কারণ ছিল যে কেউ না জানতে পারে শিশির তাকে নিয়ে এসেছে। শিশির গিয়ে অশোকনাথের সঙ্গে দেখা করলো আর বললো তিনি রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে এসেছেন আর উনি একটা বিশেষ মিশনে যাচ্ছেন তিনি ছদ্ববেশে আছেন।শিশির অশোকনাথকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে দিলেন কি কি করতে হবে কি কি বলতে হবে তারপর সুভাষ আসলেন এবং সেই মতো অভিনয় করতে লাগলেন যাতে কেউ কিছুই বুঝতে না পারে।১৭ জানুয়ারি গোটা দিন চললো নাটক।তারপর সুভাষ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আসানসোল নয় ,গোমো স্টেশন থেকে কালকা মেইল ট্রেন ধরবেন।সেইমতো পরিকল্পনা করা হলো, শীতের সন্ধ্যায় সবার সামনে লোক দেখানো বিদায় নিলেন সুভাষ। কিছু দূর পথ গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুভাষ। একটু পরে অশোকনাথ, তার স্ত্রী ও শিশির এলো গাড়ি নিয়ে আর উঠে পড়লেন ছদ্মবেশী সুভাষ।তারপর সেখান থেকে রওনা দিলো গোমো স্টেশন এর দিকে , শিশির চালাচ্ছিল গাড়ি আর পথ বলছিলো অশোকনাথ।প্রায় মধ্যরাতে পৌঁছালো তারা গোমো স্টেশনে , স্টেশনে নেমে সুভাষ তার মালপত্র গুছিয়ে তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি চললাম, তোমার ফিরে যাও”।
সেই স্টেশন থেকে কালকা মেইল ট্রেন ধরে তিনি যান দিল্লি তারপর সেখান থেকে ট্রেন পরিবর্তন করে অন্য একটা ট্রেনে ধরে চলে যান পেশায়ার।পেশায়ার শহরে সুভাষকে নেওয়ার জন্য উপস্থিস থাকেন সেখানকার ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা মিয়ান আকবার শাহ।আকবার শাহ একটি গাড়ি ও একটি উপজাতি গাইডের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে আফগানিস্থানে পালানোর ব্যবস্থা করেছেন। আকবরের এক সহযোগী “ভগত রাম” যিনি রহমত খান নাম সেজেছিলেন আর অন্য দিকে সুভাষ একজন পাঠান সেজেছিলেন যে কথা বলতে পারে না অর্থাৎ বোবা।তিনি বোবা সেজেছিলেন কারণ তিনি সেখানকার ভাষা পাশতু বলতে পারেন না। আর কেউ জিজ্ঞাসা করলে তারা কোথায় যাচ্ছে তাহলে তার উত্তরে বলে তারা আড্ডা শরীফের মাজারে যাচ্ছে ,যাতে তার রোগ নিরাময় হতে পারে।
২৬ জানুয়ারি ১৯৪১ সাল, তারা গাড়ি নিয়ে পেশায়ার থেকে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যা হতে হতে ব্রিটিশরাজ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। ২৯ জানুয়ারি তারা আড্ডা শরীফের মাজারে পৌঁছে যায় এবং তারপর সেখান থেকে ট্রাকের মাধ্যমে কাবুলে চলে যান।কাবুলে থাকা কালীন সুভাষকে সব কিছু শিখিয়ে দেওয়া হয় কিভাবে জল পান করবে কিভাবে সহপাঠীদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করবে আর সতর্ক করা হয় মুখ থেকে যেনো কোনো শব্দ না বের হয়।কলকাতা থেকে কাবুল যেতে নেতাজির ১৫ দিন সময় লাগে।ওই দিকে কলকাতাতে ইংরেজ সরকারকে নেতাজির পালানোর ১২ দিন পরে খোঁজ মিলে। ২৭ জানুয়ারি যখন সুভাষকে মামলার জন্য আদালতে পেশ করার জন্য ডাকা হলো তখন ব্রিটিশ সরকার জানতে পারলো সুভাষ বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সুভাষ এই পালানোর পরিকল্পনাকে এতটাই গোপন রেখেছিলো যে তার নিজের মা ও জানতো না যে সুভাষ বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সব দিনের মতোই সুভাষকে ঘরের বাইরে খাবার দেওয়া হতো আর ঘরের মধ্যে থাকা তার ভাইপোরা সেই খাবার খেয়ে নিতো ,এই দেখে তার বাড়ির লোক এমনকি ইংরেজদের পোষা গোয়েন্দারাও ধরতে পারে নি যে সুভাষ ঘরে নাই। ২৭ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় নেতাজি নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে তারপর আস্তে আস্তে সারা দুনিয়ায় খবরটা ছড়িয়ে পরে।এই খবরটা ছড়িয়ে যাওয়ার পরে ব্রিটিশ সরকার অনেক ধরণের খবর পায় যে নেতাজি এই সব জায়গায় হয়তো গিয়েছে কিন্তু কোনো সঠিক খবর তারা পায় না। এই সন্দেহের জেরে ব্রিটিশ সরকার একটা জাপানি জাহাজকে জেরা করে যেটা কলকাতা থেকে জাপান যাচ্ছিলো কিন্তু সেখানেও তারা কোনো কিছু খুঁজে পায় না।সুভাষ বাড়ি থেকে পালানোর সময়ই শিশিরকে বলেছিলো যে তার পালানোর খবরটা কোনো রকমে ৪ -৫ দিন প্রযন্ত ঢাকা থাকে তাহলে তাকে ব্রিটিশ সরকার আর কোনো দিন ধরতে পারবেন না। আর ঠিক তাই হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার তাকে আর ধরতে পারে নি।
সীমান্ত অতিক্রম করে কাবুলে গিয়ে তিনি সোভিয়েত উনিয়ন যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকেন। তাই তিনি সেখানকার সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন কিন্তু তারা তাকে সাহায্য করতে পারবেন না জানিয়ে দেন। কারণ তারা সুভাষকে একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর ভেবে নিয়েছিলেন। দিয়ে সুভাষ শেষ প্রযন্ত জার্মান দূতাবাসে যান এবং তাদের কাছে সাহায্য চান।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে জার্মান মিনিস্টার হ্যানস পিলগের যিনি জার্মান দূতাবাসে উপস্থিত ছিলেন তিনি একটা টেলিগ্রাফ করেন জার্মান বৈদেশিক মন্ত্রীকে সুভাষের সম্পর্কে জানায় আর বলে সুভাষের সঙ্গে দেখা করে তাকে যে যে উপদেশ দিয়েছে সেটাও জানায় আর বলেন তিনি নিজের পক্ষ থেকে রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন যাতে তারা সুভাষের সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তার কিছু দিন পরে সুভাষ জানতে পারে আফগানিস্থান থেকে বের হতে গেলে তাকে ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করা উচিত।
ঠিক তাই মতো ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে সুভাষের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎকার হয় এবং সুভাষকে বলা হয় একটা ইতালীয় পাসপোর্ট তৈরী করার জন্য। তারপর সুভাষকে নতুন একটা ইতালীয় পাসপোর্ট দেওয়া হয় একটা নতুন নামে। সেই পাসপোর্ট অনুযায়ী সুভাষের এখন নতুন নাম ছিল অরল্যান্ডো মেজোট্টা।
এর মাঝেই ব্রিটিশ সরকার জানতে পেরে যায় যে সুভাষ কাবুলে আছে আর সে সেখান থেকে জার্মানি যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তাই ব্রিটিশ সরকার তার ২ জন গুপ্তচরকে সুভাষকে মারার জন্য পাঠিয়ে দেই। সেই দু জনকে বলা হয় সুভাষকে খুঁজে বার করতে আর তাকে যেখানেই দেখতে পাবে সেখানেই যেন তাকে হত্যা করে দেওয়া হয়। এই জন্য তাদেকে তুর্কিতে পাঠানো হয়। কিন্তু আমাদের সুভাষ ছিলেন তাদের থেকেও চালাক ইউরোপ যাওয়ার জন্য তিনি মধ্যে প্রাচ্য রাস্তা না নিয়ে পৌঁছে যান মস্কো তার নুতুন নাম নিয়ে। আর সেখান থেকে একটা ট্রেনে করে চলে আসেন জার্মানির রাজধানী বার্লিন।
আর এই ভাবেই ০২ এপ্রিল ১৯৪১ সালে তিনি সফলভাবে জার্মানিতে পৌঁছে যান। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ৭৬ দিনের পরিশ্রমের পরে জার্মানিতে পৌছাতে পেরেছিলেন।